মনের জানালায় : কল্পনা মিত্র


প্রচন্ড একটা শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল অর্ঘর,ধরমর করে উঠে বসলো বিছানায়। দেখলো মিষ্টি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাহলে কি শব্দটা হয়নি! মিষ্টির ঘুম খুব পাতলা একটু শব্দেই ঘুম ভেঙ্গে যায় তার। তাহলে কি স্বপ্ন দেখছিল! দূর আর ভাবতে পারছে না। দুচোখে ঘুম ছেয়ে আসছে। ঘুমিয়ে পরবে আবার, নাকি একবার ঘরময় উঁকি ঝুঁকি মেরে আসবে! দূর ছাই!মিষ্টিকে জড়িয়ে সে সেকেন্ড রাউন্ড ঘুমোতে শুলো।সকালে ঘুম ভাঙ্গলো মিষ্টির রাম ধাক্কায়,-"এই শুনছো, আমাদের কিচেনের জানলার কাঁচটা ভাঙ্গা।" বেচারির অতজোর ধাক্কা খেয়েও উঠে বসতে ইচ্ছা করছিল না। পাশ বালিশ বুক জাপটে পাশ  ফিরতে ফিরতে বললো -"আমি শব্দ পেয়েছিলাম  মাঝরাত্রে।" মিষ্টি  চোখ কপালে তুলে বললো,-"শব্দ পেয়েছিলে তো আমাকে ডাকলে না কেন?"

-"শব্দ হতেও তুমি জাগলে না দেখে ভাবলাম স্বপ্ন দেখেছি।"

-"উঃ তোমাকে নিয়ে পারি না বিশ্বাস করো।" অর্ঘ পাশবালিশ জড়িয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে বললো,

--"একটা কথা বুঝলাম না কিছুতেই যে অতজোড় শব্দেও তুমি জাগলে না কেন!"

--"বাঃ!  আমি শুনবো কি করে,আমি তো কানে তুলো গুঁজে শুয়েছিলাম।"

-"কেন--কেন কানে তুলো গুঁজে কেন শুয়েছিলে?" পাশ বালিশ কোলে উঠে বসলো অর্ঘ। মিষ্টি ওর নাকটা দুআঙ্গুল দিয়ে নেড়ে বললো,-"বাবু যে ঘুমলেই নাক ডাকেন...সেই জ্বালায়।" অর্ঘ লজ্জিত হলো তবু মাথা চুলকে বুদ্ধি যুগিয়ে বললো

--"ভাগ‍্যি তোমায় ডাকিনি তা নাহলে ওই মাঝ রাত্রেই তুমি কিচেনের মেঝে থেকে কাঁচ পরিষ্কার  করতে বসে যেতে। না না তোমাকে ওই কাঁচ পরিষ্কার করতে হবেনা, তোমার হাতে ভাঙা কাঁচ ঢুকে যাবে। সরো, সরো,আমি পরিষ্কার করে দিচ্ছি।"' 


আবারও মিষ্টি ওর সরু সরু গৌর বর্ণের আঙ্গুল দিয়ে অর্ঘর নাকটা মিষ্টি করে নেড়ে দিয়ে বললো,

-" জানলাটার বাইরের দিকে পাল্লা মশাই, তাই কাঁচ গুলো কিচেনে পরেনি পরেছে বাইরে একতলায়।"


লগডাউন চলছে, সুতরাং মিস্ত্রি ডাকা সম্ভব নয়। অর্ঘ অনেকবার ভাঙ্গা জায়গাটা পেপার দিয়ে ঢেকে দিতে চাইলো মিষ্টি রাজি হলোনা। কেনো রাজি হলোনা সেটা মুখেও প্রকাশ করলো না। তবে তার মনে হচ্ছে যে জানলার কাঁচ ঢিল মেরে ভেঙেছে সে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে ভেঙেছে,আজ নির্ঘাৎ আসবে তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে। মিষ্টি আজ লক্ষ‍্য রাখবে। অর্ঘকে জানাবে না, তাহলে ওর ঘুমের বারোটা বাজবে। অর্ঘ বললো,-" স্বপ্ন দেখেছি ভেবে শুয়ে পরেও হঠাৎ বাবা-মায়ের কথা মনে পরলো। এই লকডাউনের সময়টা বাড়িতে থাকলেই ভালো হতো। অফিস যাওয়ার বালাই ছিলনা। মনটা মাঝে মাঝেই ওদের জন‍্যে খারাপ হয়। জেঠা,কাকারা সঙ্গে থাকেন তাই একটু নিশ্চিন্ত থাকি।" খানিকক্ষণ চুপ থেকে অর্ঘ বললো,-"আচ্ছা,তোমাকে যদি তখন জাগাতাম তাহলে তুমি কি করতে?"

--" দেখতাম কে কাঁচটা ভাঙ্গলো।"

-"সে কি তখনও তোমার চোখে ধরা দেবে বলে দাঁড়িয়ে থাকতো! আচ্ছা বোকা মেয়ে তুমি।"

মিষ্টি মনে মনে বললো,-"ধরা তো তাকে পরতেই হবে।"


রাত্রে অর্ঘ ঘুমিয়ে পরতে সন্ধানীর দৃষ্টি নিয়ে অন্ধকার রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে রইল মিষ্টি।  মানুষটা এলো। ওপরদিকে হাত নেড়ে নেড়ে ইশারায় কার সঙ্গে কথা বলছে। পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের ওপর ভর করে উঁচু হয়ে স্ট্রীট ল‍্যাম্পের আলোয় মানুষটার মুখটা দেখার চেষ্টা করলো। নাঃ দেখতে পেলো না। কিন্তু ওপরে কার সঙ্গে ইশারায় কথা বলছে ছেলেটা! ব‍্যালকনির  দিকের দরজাটা খুলে আস্তে আস্তে বেড়িয়ে এলো। ছাদে কি কেউ আছে! তিনতলার ব‍্যালকনিতে একটু চাঁদের আলো ছাড়া স্ট্রীট ল‍্যাম্পের আলোর ছিঁটে ফোঁটারও বালাই নেই। মিষ্টি চাঁদের আলো এড়িয়ে ব‍্যলকনি থেকে ওপর-নিচটা ভালো করে দেখলো। রান্নাঘরের জানলার ওপরের ঠিক বাঁদিকে চারতলার সাতনম্বর ফ্ল‍্যাটের ব‍্যালকনি। সেই ব‍্যালকনিতে একটা হালকা পাওয়ারের আলো জ্বলছে। মিষ্টি দেখলো ওখানে দাঁড়িয়ে  মজুমদার দাদুর নাতনি মৌমিতা। সে নিজের মুখের ওপর মোবাইলের টর্চের আলো ফেলে নিচের দিকে তাকিয়ে হাসলো তারপর ঠোঁটটাতে চুম্বনের ভঙ্গি করলো। নিচের মানুষটাও নিজের মুখের ওপর মোবাইলের টর্চের আলো ফেলে হাসলো। চমকে উঠলো মিষ্টি এ হাসিমুখটা তার অনেক চেনা! প্রত‍্যুষের! প্রত‍্যুষ তার জীবনের  প্রথম ভালোবাসা। এগারো ক্লাসে পড়ার সময় কেমেস্ট্রির কোচিনে আলাপ বারো ক্লাসে প্রেম। প্রত‍্যুষও ঠোঁটটাকে চুম্বনের কায়দা করে মৌমিতাকে প্রত‍্যুত্তর দিল কিনা দেখা হলোনা মিষ্টির। প্রত‍্যুষকে দেখেই ক্ষণিকের জন‍্য  চোখ বুঁজে ফেলেছিল সে। চোখ খুলতে দেখলো প্রত‍্যুষ চলে যাচ্ছে। একবার পেছন ফিরে হাত নেড়ে  'বাই ' জানালো। মিষ্টিও অন্ধকারে দাঁড়িয়ে প্রত‍্যুষের মতন হাত নাড়লো।


মিষ্টির বিছানায় শুয়েও কিছুতে ঘুম আসেনা। এই মুহূর্তে নিজেকে কেমন একটা শিড়দাড়া শূণ‍্য অবিশ্বাসী মনে হচ্ছে। একজনকে ভালোবেসে কি করে আর একজনকে সে এতো ভালোবাসলো! তাও কি সম্ভব! সেই ভালোবাসাটা যদি সত‍্যি না হয় আজকের  ভালোবাসাটা কি করে খাঁটি হতে পারে?নিজেকে সন্দেহের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে উঠে বসলো বিছানায়, ঘুমন্ত অর্ঘকে দেখলো। বুকের ওপর হাত দিয়ে শুয়ে নাক ডাকছে মানুষটা। একটু পাশ ফিরিয়ে দিল। নাক ডাকা থামলো। আচ্ছা ও কি সত‍্যি ভালোবাসতো প্রত‍্যুষকে? আবার আগের প্রশ্নগুলোর সমাধান হাতরাতে লাগলো সে। নিশ্চয়ই ওটা ভালোবাসা ছিল না, ছিল একটা  ভালোবাসা ভালোবাসা খেলা। অর্ঘর সাথে বিয়ের কথাবার্তা চলার সময় মিষ্টি মায়ের কাছে বলেছিল প্রত‍্যুষের কথা। মা মাথায় হাত বুলিয়ে কাছে টেনে নিয়ে  বলেছিলেন "এটা এই বয়সের একটা মোহ। কাউকে বন্ধু করে পাওয়ার স্বাধীনতার ব‍্যবহার। বন্ধু যে শুধু মেয়েই হতে পারে তা নয়, ছেলেরাও বন্ধু হয়। কিন্তু   সে ছেলে বলেই যে তুমি ভালোবাসো সেটা নয়। ছেলে বন্ধুদের মধ‍্যে কোন এক বিশেষ বন্ধুকে তুমি বিশেষ চোখে দেখো সেটা অবশ‍্যই ভালোবাসা।তোমাকে তোমার এই নতুন জীবনে ঢোকার আগে অবশ‍্যই ভাবতে হবে ওকে তুমি কতোটা ভালোবাসো,আর সেই ভালোবাসা তোমার বাবার যুক্তি আর পরিবারের গুরুত্বের চাইতেও গুরুতর কিনা! তাহলে আমাদেরও ভেবে দেখতে হবে।" বাবাকে প্রত‍্যুষের কথা বলতে পারেনি মিষ্টি তার লজ্জা তাকে বলতে দেয়নি, কিন্তু ছোটবোন শ্রুতি তার চাইতে বয়সে ছোট হয়েও লজ্জার আবরণ থেকে অনেক আগেই আর বেশ সহজেই বেড়িয়ে এসেছিল। মিষ্টির বিয়ের পেছনে সেই কারণটাও প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল।


লক্ ডাউনের কারণে অর্ঘ ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছে। অফিস যাওয়ার ব‍্যস্ততা নেই তার ওপর আজ শনিবার ছুটির দিন,তাই মিষ্টিকে আজ ঘুমোতে দেখেও ডাকলো না। বছর দুই হয়েছে ওরা বিয়ে করেছে। বর্ধমানের ছেলে। রোজ কলকাতা থেকে বর্ধমান যাওয়া আসা চাপের হতো বলে কলকাতায় এক পরিবারে পেইংগেস্ট হয়ে থাকতো। শুক্রবার করে বাড়ি ফিরতো আবার সোমবার সরাসরি অফিসে আসতো। বিয়ের পরও মিষ্টিকে বাবা মার কাছে রেখে একই নিয়মে কলকাতায় চার রাত্রি কাটিয়ে তিন রাত্রি বর্ধমানে কাটাতো। বছরখানেক হলো বাবা-মায়ের পীড়াপীড়িতে কলকাতায়  মিষ্টির বাপের বাড়ির কাছাকাছি এই ফ্ল‍্যাটটা ভাড়া নিয়েছিল। মিষ্টি এখানে পনেরো দিন বর্ধমানে পনেরো দিন করে থাকতো। হঠাৎ লকডাউন শুরু হওয়ায় ওরা দুজনেই বর্ধমান ফিরতে পারেনি। 


জানলা দিয়ে রোদ ঢুকছে দেখে জানলার পর্দাটা টেনে দিয়ে ফুরফুরে মনে কিচেনে চা করতে গেল অর্ঘ। রোজ মিষ্টি ওকে বেডটি দেয় আজ ও মিষ্টিকে দেবে। চায়ের ট্রেটা বেড সাইড টেবিলে নামিয়ে রেখে দেখলো মিষ্টি যেমনটি শুয়ে ছিল ঠিক তেমনটি শুয়ে ঘুমাচ্ছে। অর্ঘ একটু অবাক হলো। নিজের হাতটা ওর কপালে ছুঁইয়ে দেখলো জ্বর হয়েছে কিনা। কিচেন থেকে আসা অর্ঘের জলে ভিজে ঠাণ্ডা হাতটা কপালে লাগতে মিষ্টি চোখ মেললো। মিষ্টির ওপর ঝুঁকে থাকা অর্ঘ মিষ্টির মিষ্টি ঠৌঁটে আলতো করে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে বোললো,-"গুড মর্নিং। তুমি সুস্থ আছো বুঝে খুব খুশী হয়েছি আমি।" মিষ্টি লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠে বসলো।

 -" ইস্ আমার জাগতে এতো বেলা হবে বুঝলে আমি কিছুতেই শেষ সকালে ঘুমাতাম না।" অর্ঘ চায়ের কাপটা ওর দিকে এগিয়ে  দিয়ে বললো,-"বেশ করছো শেষ রাত্রে ঘুমিয়েছো তা না হলে তোমাকে ঘুমোলেও এতো মিষ্টি দেখায় বুঝতাম কি করে! নাও আজ আমার হাতের চা খাও।" অর্ঘ নিজের কাপটা হাতে তুলে বললো,-"মিষ্টি,আজ তুমি কিচেনে ঢুকবে না আমি তোমাকে আজ রান্না করে খাওয়াবো ডিমের ঝোল আর ভাত।"

 --"এ মা! না না, প্লিজ, এরকম কোরোনা শেষে আজ দুজনকেই না খেয়ে থাকতে হবে তারচাইতে যদি বলো ডিমসেদ্ধ ভাত খাওয়াবে তো আমি রাজি আছি।" মিষ্টি হাসতে হাসতে উত্তর দিল। অর্ঘও  অভিমানী মুখ করে বললো,-"বুঝতে পারছি তুমি আমার রান্না খেতে ভয় পাচ্ছো।" পরমুহূর্তে মুখে চর্তুরগুণ হাসি ঝড়িয়ে বললো,-"ওয়েল আজ ওই ডিম সেদ্ধ আর ভাত তুমিই রেঁধে দেখাও আমি চেখে বলবো কেমন রান্না হয়েছে।"একটু থেমে অর্ঘ বললো,-"জানো মিষ্টি,আজ ঘুমন্ত তোমার দিকে তাকিয়ে থাকত‍ে থাকতে হঠাৎ বাবা-মায়ের কথা মনে পরলো। এই লকডাউনের সময়টা বাড়িতে থাকলেই ভালো হতো। অফিস যাওয়ার বালাই ছিলনা। মনটা মাঝে মাঝেই ওদের জন‍্যে খারাপ হয়। তুমি ওখানে থাকতে পনেরো দিন আমার কাছে পনেরো দিন, তোমাকে পুরোপুরি কাছে পেতাম না বলে আফসোস হলেও বাবা মায়ের ব‍্যাপারে এমন মন খারাপ করতো না। কতোও দিন হলো বাবা-মাকে দেখিনি। জেঠা,কাকারা সঙ্গে থাকেন তাই একটু নিশ্চিন্ত থাকি। আর তুমি তো একই শহরে এতো কাছাকাছি থেকেও তোমার বাবা-মায়ের সাথে দেখা কি তাঁদের কাছেও যেতে পারো না। কবে যে এই মহামারি আর এই লকডাউন থেকে রেহাই পাবো কে জানে!"


আজ ওদের সকালটা দেরী করে শুরু হলেও লাঞ্চ ওরা ঠিক সময়েই করলো। খাওয়া দাওয়ার শেষে মিষ্টি যখন রান্নাঘরে বাসন পরিষ্কার করছিল সেই সময় অর্ঘ সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেল। উদ্দেশ‍্য কিচেনের জানলার কাঁচটা কিভাবে ভাঙতে পারে সেটা আন্দাজ করা। মজুমদার বাবু বলছিলেন লকডাউনে অনেকের রুজি-রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে তাই চোরের উপদ্রব বাড়ার সম্ভাবনা আছে। তাহলে একাজ যদি কোন চোরের হয় সে তার উদ্দেশ্য সফল করতে কোনো ড্রেনপাইপ বেয়ে ওদের কাঁচ ভাঙা জানলা দিয়ে কিচেনে ঢুকতে পারবে কিনা সেটা দেখা জরুরি। গতকাল অফিসের কাজের প্রেসার ছিল তাই দেখার সুযোগ পায়নি আজ দিনের আলোতে দেখে নিলে ভালোই হয়। মজুমদার বাবুর কথা শোনার পর থেকে অর্ঘর মাথায় একটা চিন্তা উঁকি মারছে, ফ্ল‍্যাট বাড়িগুলোতে সাধারনত রান্নাঘরে কোন আলাদা দরজা থাকে না তাই কেউ যদি ওই ভাঙা জানলা দিয়ে কিচেনে ঢুকতে পারে তাহলে তো তার কেল্লা ফতে। ঘরের মানুষগুলোকে ঘুমের ওষুধ স্প্রে করে ঘুম পারিয়ে আরাম করে সর্বসান্ত করতে পারে।


মিষ্টি রান্নাঘরের কাজ শেষ করে ড্রইংরুমে আসার সাথে সাথে অর্ঘ একতলা থেকে ফিরে এলো। মিষ্টি কর্ণার টেবিল থেকে স‍্য‍্যনিটাইজারের বোতলটা নিয়ে  অর্ঘর দিকে এগিয়ে যেতে অর্ঘ হাতের মুঠি খুলে বললো,-"এটাতেও একটু স্প্রে কর, দেখতে হবে এটা  কি।"মিষ্টি দেখলো অর্ঘের হাতের মুঠোতে কাগজে মোরা ছোট্ট দলা পাকানো একটা কিছু। জিজ্ঞাসা করলো,-"এটা কি?" অর্ঘ বললো,-"ভাবছিলাম  জানলাটা ভাঙ্গলো কি করে! ঢিল খুঁজছিলাম ছুঁড়ে দেখবো তিন তলায় টিপ করে কিছু ছুঁড়তে পারি কিনা। খুঁজতে গিয়ে দেখি কাগজে মোড়া এটা। দেখো, একটা ছোট ঢিলে মুড়ে দলা পাকানো এটা...কি..." কথা বলতে বলতে মোড়কটা খুলছিল অর্ঘ,-"আরে এটা একটা দুলাইনের প্রেমপত্র....!" মিষ্টি রাগত স্বরে বলতে যাচ্ছিল,-"কেন এসব মোড়ক টোড়ক কুড়োতে গেলে! বোম-টোমও তো হতে পারতো..." বলা হয়ে উঠলো না তার আগেই  অর্ঘর"প্রেমপত্র"কথাটা কানে যেতেই ও ধপ্ করে সোফার ওপর ওর পাশে বসে পরলো। অর্ঘর হাত থেকে চিরকূটটা নিয়ে মিষ্টি স্তম্ভিত! অস্ফুট স্বরে বললো,-"প্রত‍্যুষ!" অর্ঘ শুনতে পেলোনা সে হেসেই অস্থির।-" বাপরে বাপ! এই মোবাইলের যুগে বাপ-মার আমলের প্রেমপত্র! তায় আবার  ঢিলে মুড়ে...ভাবা যায়! দারুণ একটা নোভেল নোভেল ব‍্যাপারটা।"


অনেক কষ্টে শেষ সকালে ঘুম এসেছিল মিষ্টির।সকালটা সুন্দর ভাবে শুরু হয়েছিল।মনের মধ‍্যে মুহূর্তের জন‍্যেও কাল রাত্রের ঘটনা উঁকি মারেনি।বেলা করে রান্না চাপিয়েছিল বলে জানলাটার দিক একবারও চোখ পরেনি। কেমন একটা মিষ্টি মধুর সুখে আচ্ছন্ন ছিল সে। এই ঢিলে মোড়া কাগজটা তার পুরোনো ভাবনাকে স্পর্শ করলো।

....-"কিন্তু ভাবছি এই প্রেমপত্রটা কার উদ্দেশ্যে..."অর্ঘর শেষ বাক‍্যকটা মিষ্টির কানে প্রবেশ করতেই মিষ্টি উচ্চারণ করলো,-"মৌমিতার।"

-"কে মৌমিতা?"

--"চারতলার সাত নম্বর ঘরের মজুমদার বাবুর নাতনি।"

-"ওঃ! তুমি জানলে কি করে! মৌমিতা না কে.,..ওই মেয়েটা তোমাকে বলেছে? কখন কথা হলো তার সাথে?"

-"কাল রাত্রে।"

-"কাল রাত্রে..কখন!"

-পরশু যে জানলার কাঁচ ভেঙেছে বুঝতে পারছি সে চোর নয়।"

-"চোরের কথা বাদ দাও মিষ্টি, আগে বলো মেয়েটা কি বলেছে....।" রোমান্টিক গল্প শোনার  উদ্দেশ্যে অর্ঘ মিষ্টির গা ঘেঁষে বসলো।

-"না মেয়েটা আমাকে বলেনি,আমি দেখেছি কাল রাত্রে....ছেলেটা এসেছিল..."

-"মানে! "অর্ঘ আশ্চর্য হলো। -"তুমি দেখলে কি করে?"

-আমি কাল চোর দেখার জন‍্য মানে যে কিচেনের জানলার কাঁচ ভেঙেছে সে নির্ঘাত আজ আসবে এই ধারণা করে জেগে ছিলাম। তুমি ঘুমোলে উঠে এসেছিলাম  কিচেনে। দেখলাম ছেলেটাকে, মৌমিতা  ছিল চারতলার ব‍্যালকনিতে...।"

-"আমাকে বললেনা তো সকালে...সে জন‍্য তোমার শুতে আর ঘুমোতে দেরি হয়েছিল...!"মিষ্টিকে কাছে টেনে নিল অর্ঘ।

-"ভুলে গিয়েছিলাম। সত‍্যি বলছি।" মিষ্টির অপরাধী মনে হচ্ছিল নিজেকে, ততক্ষণে নিজেকে অর্ঘের বুকের মধ‍্যে বন্দিনী আবিস্কার করে সহজ হলো সে, মিষ্টি হেসে বললো,-"সকাল থেকে যা শুরু করেছো তুমি, আমার তো সবই ভুল হয়ে যাচ্ছিল....দেখলেনা ব্রেকফাস্ট  দিতেই কতো দেরী করলাম আর রান্না চাপাতেও দেরী....।" অর্ঘর ঘনিষ্ঠ আকর্ষণে ওর কথা ওখানেই থেমে গেল।


কাল রবিবার তাই আজ একটু রাত জাগাই যায়। বিছানায় শুয়ে আজ অর্ঘ বললো,-"আজ কিন্তু  আমরা দুজনে ওই প্রাচীনধর্মী প্রেমকাব‍্য চাক্ষুষ দেখবো মিষ্টি। "সেই মতন কাজ হলো। চাঁদের আলো এড়িয়ে ব‍্যালকনির অন্ধকার দিকে ওরা দুজন দাঁড়িয়ে আজ দেখলো এক প্রেমিক প্রেমিকার গোপন অভিসার !..বাস্তব আলিঙ্গনের উর্দ্ধেও যে এই আলিঙ্গন এতো রোমান্টিক...আর...হৃদয়স্পর্শী হয়..ওরা বিস্ময় মাখানো দৃষ্টিতে তাই দেখলো। মিষ্টি দেখলো প্রত‍্যুষকে। কিরকম বাতাসে ওড়ানো চুম্বন দিয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানালো সে!....প্রত‍্যুষের চলে যাওয়া...অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়ার পরও কিছুক্ষণ কেটে গেল। অর্ঘ বললো '-"এটা মানতেই হবে দেখা সাক্ষাতের সুযোগহীন লকডাউনের সময়ের এই অভিসার অনিন্দ‍্য সুন্দর!" অর্ঘের মতে লকডাউনের কারণে মৌমিতা নামের মেয়েটা বাড়ি থেকে বেড়োতে পারছেনা তাই মোবাইলের ভিডিওকলের ঊর্ধ্বে  সামনাসামনি  সাক্ষাতের প্রয়োজনে ওদের এই নিশাকালের নিষ্পাপ অভিসার মন্দ নয়। ওদের এই পবিত্র প্রেম দেখার পর ঘুম না আসাই স্বাভাবিক।


মিষ্টি হঠাৎ বললো -" অর্ঘ আমি ছেলেটাকে চিনি। ওর নাম প্রত‍্যুষ।" অর্ঘ উৎসাহ ভরে প্রশ্ন করলো,-"তাই নাকি?"

-"হুম, ও আমার ক্লাস মেট ছিল। কেমেস্ট্র কোচিনে ওর সাথে আলাপ। ক্লাস টুএলভ থেকে ও আমার বয় ফ্রেন্ড ছিল।"

--" বাঃ! এই সেই হিরো।" অর্ঘের মুখে কৌতুকের ছটা। -"বলো বলো তোমার সেই প্রেম কাহিনী... আর বল কবে ব্রেকআপ হলো আর কেন।"

-"শ্রুতি মানে আমার ছোট বোনের বিয়ে দেওয়াটা জরুরি ছিল তাই বাবা ওর আগে আমার মানে তাঁর বড় মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন‍্য উঠেপরে লাগলেন...আমায় কোন কথা বলার সুযোগ দিলেন না। প্রত‍্যুষকে বলারও সুযোগও পেলাম না। মাকে বলেছিলাম। মা অনেক ভাবে আমাকে বুঝিয়েছিলেন। বাবাকে বলে ফল হবে না বুঝেও মা বুঝিয়েছিলেন, তার সঙ্গে এটাও বলেছিলেন যে- 'প্রত‍্যুষ আমার সমবয়সী আর এখনো স্টুডেন্ট। ওর সঙ্গে বিয়ে করতে হলে আমাকে আরও চার-পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে, তাতে বাবা রাজি হবেন না কারণ শ্রুতির বিয়েটা দিতেই হবে। ' জানোতো শান্তনুদার বিদেশে ফেরার তারা ছিল আর শ্রুতির ওখানে এ‍্যাডমিশন নেওয়ারও তাড়া ছিল। আমার  সাহস হয়নি সড়াসড়ি বাবাকে কিছু বলার।" অর্ঘ একটু গম্ভীর গলায় বললো -"হুম, সেম কেস....এই রকমটা আমার বেলাতেও হয়েছিল। ইন্দ্রাণীও ওর বাবাকে কিছু বলতে পারেনি। জানো আমার ধারণা, বাবা-মায়েরা নিজেদের মেয়েদের যেভাবে আদর যত্নে রাখেন সেই মেয়েকে পরের বাড়ি পাঠানোর সময় একটু বয়সে বড় ছেলে খোঁজেন যার ওপর ভরসা করে তার হাতে নিজের পরম আদরের মেয়েটাকে সমর্পণ করা যায়, যার কাছে থেকে মেয়ে একটু হলেও আদর যত্ন পেতে পারে। এখানে  তাঁদের দোষ দিয়ে লাভ নেই।" 


-চাঁদের  আলো ততক্ষণে ব‍্যালকনির অন্ধকারাচ্ছন্নকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে। সেই আলোয় মিষ্টিকে বড়ই রহস‍্যময়ী লাগছে। আজ এই রহস‍্যময়ীর সমস্ত রহস‍্য উন্মোচনের দায়িত্ব নিয়েছে অর্ঘ। সে সেই রহস‍্যময়ীকে প্রশ্ন করলো,-" তারপর বলো, তোমার  প্রত‍্যুষের কথা, সে কি বলেছিল?"


-"  বিয়ের  আগে আমার প্রত‍্যুষের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি আর আমিও চেষ্টা করিনি। বিয়ের একবছর পরে দেখা হয়েছিল রাস্তায়। বললো,-"আর ক'টা বছর অপেক্ষা করতে পারতিস।" বল্লাম,-"বোনের বিয়ে দেওয়ার তাড়া ছিল তাই বাবা সাতদিনের মধ‍্যে আমার  বিয়ে দিয়েছিলেন।"প্রত‍্যুষ বলেছিল,-'যে বোনের বিয়ের তাড়ায় তুই আমাকে ছাড়লি তার তো শুনলাম এরই মধ‍্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।' অর্ঘ, সত‍্যি বলছি সেদিন আমার খুব খারাপ লাগছিল প্রত‍্যুষের জন‍্য। আমার যে হঠাৎ বিয়ে হয়ে যাবে সেটা ও একেবারেই ভাবতে পারেনি। আমার ফোনের সুইচড অফ্ দেখে ভেবেছিল আমি হয়তো অসুস্থ। খুব দুশ্চিন্তায় ছিল। পরে বন্ধুদের কাছে আমার বিয়ে হয়ে গেছে শুনে অনেকদিন কষ্ট পেয়েছিল। আমার হয়তো ওকে আগেই বলা উচিত ছিল। আমি ওর  মুখোমুখি হতে ভয় পেয়েছিলাম ।পাছে ওর মেসেজ আসে কিংবা আমার ফোন করতে ইচ্ছা করে এইসব ভেবে ফোনটা সুইচ অফ করে আলমারিতে রেখে দিয়েছিলাম। এখন প্রত‍্যুষ মৌমিতার সাথে প্রেম করছে দেখে ভালো লাগছে।" অর্ঘ চুপ করে মিষ্টিকে দেখছিল,আর শুনছিল ওর অকপট স্বীকারোক্তি। শেষের দিকে প্রত‍্যুষকে মৌমিতার সঙ্গে প্রেম করছে দেখে তার  ভালো লাগছে কথাটা বলার সময় মিষ্টির চোখে মুখে যে পরম প্রশান্তি ছেয়ে ছিল তা বড়ই পবিত্র মনে হলো অর্ঘর। মিষ্টি বললো -"অর্ঘ চলো আমরা অন‍্য কোথাও  অন‍্য কোন ফ্ল‍্যাট ভাড়া করি....?" অর্ঘ বললো -" মিষ্টি পৃথিবীটা বড্ড ছোট আর গোল, যার থেকে পালাতে চাইছো তার সাথে ঠিকই দেখা হয়ে যাবে তোমার আজ নয় কাল। কোথায় পালাবে তুমি? দেখো, আমার সাথে হয়তো কোননা কোনোদিন ইন্দ্রাণীর দেখা হতেই পারে। হয়তো, এই বয়সে নয় আর একটু বেশী বয়সে। তখন দেখা হলে আমাদের ঘা টা অনেকটা শুকিয়ে যাবে। কিন্তু একটা চিনচিনে যন্ত্রণা উঁকি মারতেই পারে। যেমন তোমার প্রত‍্যুষকে দেখার পর হচ্ছে..। জানো প্রত‍্যুষের মতন আমিও একদিন বেদনায় আহত হয়েছিলাম। জানিনা ইন্দ্রাণীর সে যন্ত্রণা হয়েছিল কিনা। ওর বিয়ের কিছুদিনের মধ‍্যে যদি দেখা হতো, যদি হাতের কাছে তাকে পেতাম তাহলে হয়তো আমি ভিলেন পযর্ন্ত হতে পারতাম। কখনও মনে হয়েছিল আত্মহত‍্যা করি...কখনও ভেবেছি ইন্দ্রাণীকে লোভী ভেবে ঘৃণা করি। অনেক তর্ক-বিতর্ক করেছিলাম মনের সঙ্গে। ইন্দ্রণী যদি অর্থের লোভে আমাকে ছেড়ে ধনী ছেলেকে বিয়ে করতো তাহলে বলতে পারতাম যে সে আমাকে ঠকিয়েছে। যদিও বন্ধুদের কাছে জেনেছিলাম সে কোন চাপে পরে বিয়ে করতে বাধ‍্য হয়েছিল। হয়তো বাবাকে বলতে পারেনি, হয়তো আমার ওপর ওর আস্থা ছিল না, তাছাড়া  তখনও আমিও স্টুডেন্ট ছিলাম। তখনই বিয়ে করার কথা ভাবার অবস্থায় আমি ছিলাম না। তবে আমাকে জানালে হয়তো কিছু চেষ্টা করতাম। বেশ বুঝতে পারি - এখন দেখা হলে আমার আর সেই যন্ত্রণা হবে না বরং হয়তো বলে ফেলবো 'ভালোই করেছিস তুই বিয়ে করে। নাহলে মিষ্টির মতন মিষ্টি মেয়েটাকে আমি আমার জীবন সঙ্গিনী করে পেতাম না।' ঠিক বলছি মিষ্টি, তোমাকে আমার জীবনে পেয়ে আমি ভীষণ খুশী।" বিয়ের এতোদিন পরেও অর্ঘের মুখে এই কথাটা শুনে লজ্জিতা মিষ্টি লজ্জায় অর্ঘর বুকের মধ‍্যে মিশে যেতে চাইলো। বুকের মধ‍্যে মুখ গুঁজে বললো-"আমিও তোমাকে পেয়ে ভীষণ খুশী।" "অর্ঘ মিষ্টির  মাথায়  হাত বুলিয়ে  বললো,-" তোমার  জীবনে প্রত‍্যুষ আর আমার জীবনে ইন্দ্রণী আমাদের  চলার পথের স্বপ্ন দেখার মতন একটা ঘটনা মাত্র আমরা সেই পথের বাঁক ঘুরে বাস্তবকে ছুঁয়ে ফেলেছি। তাই আত্মগোপন করে আত্মরক্ষা নয় আত্মবিশ্বাস রেখে বাস্তবের মুখোমুখি  দাঁড়ানোটাই ভালো। দেখো চাঁদ তার নিজের সুশীতল আলো দিয়ে আমাদের মনের সমস্ত অন্ধকার কাটিয়ে আলোময় করে তুলেছে। চলো,অনেক রাত হলো, ঘরে চলো এবার আমরা শুয়ে পরি।" 

Post a Comment

Previous Post Next Post